প্রসঙ্গ দুর্গোৎসব ১৪৩১/ ২০২৪ – নির্মাণ প্রসঙ্গ ১

প্রসঙ্গ দুর্গোৎসব ১৪৩১/ ২০২৪
নির্মাণ প্রসঙ্গ ১
পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘ ১৬ তম বর্ষ
সৃজন ভাবনা – ‘কলকাতার মূর্তি কথা’
প্রধান নকশাকার – পার্থ দাশগুপ্ত
কথাকার- দেবদত্ত গুপ্ত

নগরের শোভা বর্ধনের নয়া ফরমান

সেটা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক। বঙ্গাব্দের হিসেবে ১৩১৪। শ্রীযুক্ত রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুরের লেখা একটি ইংরেজি বইয়ের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ পেল কলকাতায়। ইংরেজি বইটির নাম ‘The early History and Growth of Calcutta’ । বইটির সুন্দর বঙ্গানুবাদ করেন সুবলচন্দ্র মিত্র। কথিত আছে রাজা বাহাদুরের বইটি ভারত শুধু নয় ইংল্যান্ডের মানচিত্রেও অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। বঙ্গলিপির বিশারদ সুবলচন্দ্রের অনুবাদিত বয়ান ধরে রাজা বাহাদুরের বইয়ের ৯১ নম্বর পাতায় জানা যায়- ‘ময়দান (গড়ের মাঠ) যে কেবল কলিকাতার বায়ুকোষ বলিয়া প্রসিদ্ধ তাহা নহে, অধিকন্তু উহার উপর বহু স্মৃতিনিদর্শন বিদ্যমান। সুপ্রসিদ্ধা মহারানী ভারতেশ্বরী ভিক্টোরিয়া হইতে আরম্ভ করিয়া বহু রাজ প্রতিনিধি, গবর্নর জেনারেল, প্রধান সেনাপতি এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ বিখ্যাত রাজপুরুষগণের প্রতিমূর্তি এই ময়দানের শোভা বৃদ্ধি করিতেছে। ঐ সমস্ত প্রতিমূর্তির অধিকাংশই ভাস্কর- বিদ্যার উৎকৃষ্ট নিদর্শন’।

আসলে নগর কলকাতা জুড়ে সেদিন অন্তরালে কাজ করেছে পৌত্তলিকতার প্রশ্রয়ের মধ্যে দিয়ে দেব মহিমা কীর্তনের নয়া উপায়। ১৮৪০ সালে ইউইজিন দেলাক্রোয়া ‘স্বাধীনতা’ কে দেবী প্রতিমা হিসেবে এঁকেছিলেন। তাঁর পরিধান ছিল রোমান দেবীর মতো। আর আমাদের দেশে ইংরেজ তাঁর সেনা নায়কের মূর্তি গড়ে দিল রোমান দেবতার আদলে ও অনুষঙ্গে। আর এমন মূর্তির স্থাপনে নির্ধারিত স্থান হল গড়ের মাঠ তথা ময়দান। শহর কলকাতার খোলা আকাশের নীচে ১৮০৩ সালে মার্কুইস কর্নওয়ালিসের মূর্তি।

এদেশের পথ চলতি মানুষের মনে নয়া দেবতার ছায়া বুনে দেওয়ার কাজ শুরু। আসলে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দুশো বছরের কিছু সময় আগে ভগ্নপক্ষ ছিন্ন মুণ্ড ‘নাইকি’ বা বিজয়ের দেবী মূর্তি গড়েন গ্রিসের ভাস্করেরা। রোমানরা তাকেই নিজেদের মূর্তিতে পাল্টে নিয়েছিল ‘ভিক্টরি’ হিসেবে। এভাবেই গ্রীক থেকে রোম আর রোম হয়ে ইংরেজ সকলেই যুগে যুগে বিজয়ীর জয় গান রচনা করেছেন মূর্তির কাঁধে ভর করে। আমাদের দেশে ভিক্টরি- র আদলেই দেখা গিয়েছে ভিক্টোরিয়ার ডানা মেলা পরী। বলতে গেলে কানু বিনে গীত নাই এর মতো মূর্তি বিনে জয়ধ্বনি নাই। স্বভাবতই নয়া রাজার নয়া ফরমান ‘মূর্তি’। আর এই নয়া ফরমানের মানচিত্রে সেদিন কলকাতার ময়দান কোল পেতে বসে রয়েছে মূর্তি ধারণের অভিলাষে। শুধু কি ময়দানের খোলা আকাশের ছায়া, সেই সঙ্গে গবর্নমেন্ট হাউস, টাউন হল, জাদুঘর, কোর্ট চত্বর, মেডিকেল কলেজ, টেলিগ্রাফ অফিস কোথায় না বসে গেল মূর্তি। রাজ পুরুষের জাহাজ নোঙর করুক কিম্বা রাজ পুরুষের বিদায়ী সম্ভাষণ, তার একটি মূর্তি গড়ার সিদ্ধান্ত হবেই হবে। চাঁদা তোলা হবে। ‘বেঙ্গাল হেরাল্ড’, ‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’, ‘লিটারারি গেজেট’ কত আলোচনা করবে মূর্তি নির্মাণের ফরমান নিয়ে। সেই সঙ্গে মূর্তির তলায় লেখা হবে ‘গুণগরিমা ও সাধারণ হিতসাধনের সমাদর ও কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ এই প্রতিকৃতি এতন্নগরবাসিগন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে’।

এরকম ভাবেই ১৮৭৪ এ কলকাতায় বসানো হল উটরামের মূর্তি। আইরিশ ভাস্কর জন হেনরি ফলি তৈরি করেছিলেন এই মূর্তি। অশ্বারূঢ় এই মূর্তির সংকেত ছিল একটি গল্পের ভিত্তি। মহারাষ্ট্রের খান্দেশে উটরাম যখন সমর শিক্ষার্থী তখন তার মেলামেশা শুরু হয় সে অঞ্চলের ভিলদের সাথে। সেখানে বড়ই বাঘের উপদ্রব। উটরাম শুরু করলেন বাঘের বিরুদ্ধে লড়াই। ভিলেরা বিশ্বাস করতেন বাঘ যদি মানুষ মারে তবে সঙ্গে সঙ্গে সেই বাঘ মেরে ফেলতে হবে, না হলে সেই মানুষের আত্মা বাঘের পিঠে চেপে গ্রামে গ্রামে তাণ্ডব চালাবে। তাই বাঘ মানুষ মেরেছে শুনলেই উটরাম ঘোড়া ছুটিয়ে রওনা দিতেন সেদিকে। বাঘ খুঁজে, মেরে হাজির করতেন ভিলদের সামনে। এভাবেই এলো উটরামের মূর্তির ঘোড়ার অনুষঙ্গ। আবার ঘোড়ার পিঠে ভাস্কর্য নির্মাণের রীতি মেনেই কিন্তু তৈরি হয়েছে উটরামের মূর্তি। ঘোড়ার সামনের ডান পা তুলে দেওয়া হয়েছে শুন্যে। আর সামনের একটি পা শুন্যে তুলে দেওয়ার অর্থ হল ঘোড়সওয়ার আহত হয়েছেন যুদ্ধে। ইতিহাস বলে দেয় নেপিয়ার যখন সিন্ধু আক্রমণ করলেন সেই সময় দুর্ধর্ষ বালুচি সৈনিকদের আক্রমণ থেকে ইংরেজ রেসিডেন্সি রক্ষা করার সময় আহত হন উটরাম। এই ভাবেই তখন বীর গাঁথা নির্ভর মূর্তি দিয়ে নগরের শোভা বর্ধনের নয়া ফরমান জারি হল ইংরেজের দ্বিতীয় রাজধানী কলকাতায়।

সঙ্গের ছবি ১৮৭৪ সালে কলকাতায় উটরামের মূর্তি উন্মোচন। উটরামের প্রতিকৃতি, তৈলচিত্র, শিল্পী অজানা ইউরোপীয় চিত্রকরদের তুলিতে কলকাতার ময়দান, গভর্নর হাউস এবং ফোর্ট উইলিয়াম।