পুজোর কথা-১ (২০২৫/১৪৩২)

পুজোর কথা-১
২০২৫/১৪৩২
সাকিন- পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘ
১৭ তম বর্ষ
কথাকার – দেবদত্ত গুপ্ত
ছবিতে- অগ্নিভ চৌধুরী

পুজো উৎসবের মাঠ যখন শিল্প দেখার ময়দান

কিছুদিন আগেও যে মাঠে পুজো হয় সেই মাঠে মানুষ পুজো দেখতেই যাবে এমনটাই ছিল দস্তুর। দেখবে প্রতিমা, মণ্ডপ ঢাকের তালে তালে ধুনুচি নাচ। বলতে গেলে এই চরিত্রের সাথে সাথেই নির্মিত হয়েছিল উৎসবের আমেজ।
সমকালের সংজ্ঞায় অনুযায়ী উৎসব এক দীর্ঘ প্রস্তুতির ফল । রথের দিন কাঠামো পুজোর লগ্নেই বলতে গেলে দুর্গা পুজোর শুরু। সময়ের সাথে সাথে এক মেটে দো মেটে পথ চলা। এর সাথে লেগে থাকে ব্যক্তি মানুষের নিজেকেও সাজিয়ে তোলার তোড়জোড়।
হুতোমের ধারায় না হলেও যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধিও লিখছেন দুর্গোৎসবের এমন দীর্ঘ প্রস্তুতির ও পুজোর সঙ্গে শিল্পের সংযুক্তির কথা। তিনি লিখছেন ‘নিকটবর্তী গ্রামের সূত্রধর প্রতিমা নির্মাণ করিত, মালাকার ডাক সাজাইত। গ্রামের মুচি ঢাক বাজাইত, দূর হইতে কি মধুর শুনাইত! চণ্ডীমণ্ডপে, আটচালায় ও চাঁদোয়া হইতে আম্রপল্লব ঝুলিতেছে। চণ্ডীমণ্ডপের দুই কোণে শিশু কদলী-বৃক্ষ, জলপূর্ণ ঘট, মুখে আম্রপল্লব শোভা পাইতেছে। যে দেখিত সে-ই বুঝিত উৎসব ক্ষেত্র’। অর্থাৎ উৎসবের আরেকটি সংকেত হল শিল্প। যে শিল্প চিহ্নিত করে উৎসবের আমেজকে।
প্রাথমিক ভাবে দুর্গা পুজোর সঙ্গে শিল্পের যে যোগ ছিল তা ছিল কেবলমাত্র উৎসবের সৌন্দর্য দানের অঙ্গ, অথবা প্রতিমার অঙ্গসজ্জার অলঙ্কার হিসেবে। শিল্পের মধ্যে দিয়ে মণ্ডপের চারপাশকে সুন্দর করে তোলা হত মাত্র। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বদল হয়েছে এমন ধারণার। পুজোর সঙ্গে তৈরি হয়েছে শিল্পের নতুন যোগাযোগ। এক দ্রুততার পথ ধরে আজকের পুজো শিল্পের দিকে ফিরে তাকিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন শর্তে। আজকের পুজো মাঠের সম্প্রসারণ হয়েছে শিল্প দেখার ক্ষেত্র হিসেবে।

আজ শিল্পীরা বিশ্বাস করতে শিখেছেন শিল্প চর্চা শুধুই গ্যালারী নির্ভর প্র্যাকটিস নয়, তা গণপরিসরের জন্যও বটে।
এই ধারণার কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে পৃথিবীর নানা প্রান্তের কিছু আর্ট ফেস্টিভ্যালের চরিত্রকে। যে ফেস্টিভ্যাল গুলির কারণে বর্তমানে সকলের শিল্প দেখার চরিত্রও যেমন পাল্টে যায় একই সাথে পাল্টে যায় শিল্প দেখানোর স্থান ধারণাও।

তখন ইউরোপে চালু হয়েছে ইন্টার রেল পথের যাতায়াত ব্যবস্থা। এই সুবিধার কারণে দেখা গেল শিল্পীরা দেশ থেকে দেশে ঘুরে ঘুরে গ্যালারি নয় পথে পথে কাজ করছেন। পথের দেওয়াল, গলি, কোনও অট্টালিকার অংশ হয়ে উঠছে শিল্প দেখানোর অল্টারনেটিভ স্পেস। ওই সময়েই আবার আর্ট ক্রাইম নামক একটি ওয়েবসাইট বিশ্বজুড়ে গ্রাফিতির প্রথম ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করে। যে আর্কাইভ বুঝতে সাহায্য করে অল্টারনেটিভ স্পেস হিসবে পথের ও রাস্তার চারপাশের ভিন্ন গুরুত্বের কথা।

কিন্তু ১৯৯৭ তে জার্মানিতে ‘মিটিং অফ স্টাইলস’ নামের ব্যনারের তলায় যখন আন্তর্জাতিক গ্রাফিতি শিল্পীরা এক ছাঁদের তলায় মিলিত হলেন সেই মিলনমেলাতেই আর্ট আর ফেস্টিভ্যাল সর্ব অর্থে সমার্থক হয়ে যায়। ২০০১ এ নরওয়ে: ন্যুআর্ট ফেস্টিভ্যাল সরাসরি স্পেস হিসেবে রাস্তাকেই চিরকালীন মনে করল আর বিশ্বের সামনে প্রথম নির্দিষ্ট স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভ্যাল হিসেবে উঠে এল। এর ঠিক সাত বছর পর ২০০৮ সালে লন্ডনের টেট মডার্ন বিপুল আকারে স্ট্রিট আর্ট প্রদর্শনীর আয়োজন করে বুঝিয়ে দিল গ্যালারি স্পেস স্বীকার করে নিয়েছে অল্টারনেটিভ স্পেসের গুরুত্বকে।। হয়। ২০০৯ মায়ামি শহরে যখন Wynwood Walls শুরু হয়, তখন দেখা গেল এই আয়োজন গোটা শহরকে স্ট্রিট আর্টের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে। এই ধারাতেই ২০১১ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস: MOCA-তে Art in the Streets প্রদর্শনী রেকর্ড দর্শক টানে। ২০১৫ ফ্রান্সে গ্রেনোবলে শুরু হয়ে যায় স্ট্রিট আর্ট ফেস্ট।

কিন্তু আমাদের দেশের এই দুর্গা পুজো সেই কবেই বাড়ির দালানের মণ্ডপ থেকে শিল্পকে সঙ্গে নিয়েই বেড়িয়ে এসেছে পথের ধারে। তাই আজকের দুর্গোৎসব সর্ব অর্থে পথের উৎসব।
দুর্গা মণ্ডপ শুধুই পুজো দেখার মণ্ডপ নয় শিল্প দেখার পুজো উৎসব। শিল্পী এবং শিল্প নিজের নিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে আর প্রদর্শনীর জন্যে বেছে নিয়েছে পুজো মাঠকে। শিল্প এখানে নিছকই প্রসাধনী নয়, সে স্বাধীন চর্চার ফল। সেখানে দুর্গা নিজেও সেই শিল্পের আঙিনায় পুজিত হচ্ছেন শিল্পকলার উদাহরণ হিসেবে।
তাই এবার পুজো মাঠের নতুন পরিচয় শিল্প দেখার পরিসর।