প্রসঙ্গ দুর্গোৎসব ১৪৩১/ ২০২৪ নির্মাণ প্রসঙ্গ ২
প্রসঙ্গ দুর্গোৎসব ১৪৩১/ ২০২৪
নির্মাণ প্রসঙ্গ ২
পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘ ১৬ তম বর্ষ
সৃজন ভাবনা – ‘কলকাতার মূর্তি কথা’
প্রধান নকশাকার – পার্থ দাশগুপ্ত
কথাকার- দেবদত্ত গুপ্ত
দুর্গা মূর্তির শিল্প বিপ্লব
শাস্ত্রে বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ, গোমেধ এই চার মহাযজ্ঞের বিধি বর্তমান। কিন্তু প্রথম দুটি যজ্ঞের অধিকার দেশপতির আর শেষের দুটি যজ্ঞ কলিতে নিষিদ্ধ। স্বভাবতই তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ তখন দুশ্চিন্তায়। কারণ যে সুলতান বংশের সৌজন্যে তিনি প্রতিষ্ঠার আলো দেখলেন সেই সুলতান বংশের পতনের উপলক্ষ তিনি নিজেই। তাই প্রায়শ্চিত্তের জন্যে যজ্ঞই একমাত্র রাস্তা। কিন্তু চার যজ্ঞই তাঁর নাগালের বাইরে। তিনি জমিদার হতে পারেন, রাজা হতে পারেন কিন্তু সার্বভৌম সম্রাট তো নন। এমত সময়ে তান্ত্রিক পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী বিধান দিলেন ‘কলিতে একমাত্র মহাযজ্ঞ হইতেছে দুর্গোৎসব’। সেই শুরু বঙ্গের দুর্গা পুজো। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তাহেরপুরের রায় বংশের প্রতিষ্ঠা। সময়ের সাথে পরিস্থিতির বদলে এই বংশের রাজা কংসনারায়ণেরও ভূমিকা বদল হয়। সেই হেতুই সুলতান বংশের সাথে তাঁর যোগ ছিন্ন হয়। পরের পর্বে শুরু বঙ্গের দুর্গা পুজো। কংসনারায়ণ যখন পুজোর প্রস্তুতি নিলেন তখন তিনি দেবীর মৃন্ময়- মূর্তি রচনা করেন। মনে করা হয় বঙ্গ দেশে সেই মাটির মূর্তিতে পুজোর শুরু। কিন্তু মার্কণ্ডেয় পুরাণে জানা যায় রাজা সুরথ দেবীর মাটির মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করেছিলেন। সেই হিসেবে কংসনারায়ণ যে পূর্বের ধারাকেই আপন ঐশ্বর্য দিয়ে অনুসরণ করলেন তাতে সন্দেহ রইল না। দেশ কাল সীমানার ইতিহাস বদলায়। একের পর এক রাজা জমিদার, ধনপতিরা তখন কংসনারায়ণের পথ ধরেছেন। পুন্যি অর্জন, লোক যোগাযোগ, আত্মগরিমা প্রকাশের অঙ্গ হয়ে উঠল দুর্গা পুজো। এই পথে অগ্রগণ্যের তালিকায় তখন কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তিনিও বহাল রাখলেন মাটির দুর্গা মূর্তি নির্মাণ প্রকল্প। আর সেই কারণেই মূর্তি বানানোর জন্যে মাটি শিল্পীদের পল্লী গড়ে দিলেন ঘূর্ণি মুলুকে। আর বঙ্গ মুলুকে ঘটে, পটে, সরায় পুজোর সঙ্গে সঙ্গে মূর্তি পূজার রীতিও স্থায়িত্ব পেল অনায়াসে। দুর্গা মূর্তি তার শৈল্পিক তকমায় উত্তীর্ণ হল ‘কংসনারায়ণী চালে’।
আজও সাবেক দুর্গা মূর্তি সেই চালকেই অনুসরণ করে। সেই চালের নিয়মে সরস্বতীর সাথে বসেন দেবসেনাপতি কার্তিক, লক্ষ্মীর সাথে আসন পাতেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। আর সিংহ বাহনে মা দুর্গা অসুরের সাথে লড়াইতে ব্যাস্ত থাকেন। সঙ্গে উপযুক্ত স্থানে বাহনেরা যুক্ত হন। এমনই ছিল কংসনারায়ণ প্রবর্তিত দুর্গা মূর্তির লক্ষণ।
আবার বদলায় সময়। ইংরেজে এলো কলকাতায়। অফুরন্ত শক্তি তখন ইংরেজের। বর্গী হানাই হোক বা অন্য সমস্যা ইংরেজের রাজধানীতেই আশ্রয় নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। তাই ভাগ্য ফেরাবার পাকে চক্রে কিম্বা নতুন রাজার অন্ন পেতে কলকাতায় আসার জন্যে গ্রাম কিম্বা শহরতলীর অনেকেই তখন ব্যস্ত। ওদিকে মুর্শিদাবাদের পতন হয়েছে, সিরাজের জমানায় তখন সূর্যাস্ত। আর সেই পলাশীর যুদ্ধ বিজয়ের উৎসব উদযাপনের অঙ্গ হয়ে গেল কলকাতার দুর্গা পুজোর । সঙ্গে মাটির মূর্তি। শোভাবাজার রাজার বাড়িতেই দুর্গা পুজোর সার্বিকতায় পলাশীর বিজয় উৎসব উদযাপনের শুরু। সাহেবসুবোরা আসছেন, তারা নগরের জেন্টু বাবু। সঙ্গে দেদার বাঈ নাচ আর খানাপিনার আয়োজন। দেখতে দেখতে কলকাতার দুর্গা পুজোর তখন নয়া যুগ। সাথে যুক্ত হয়েছে বারো ইয়ারি ধারা। স্বভাবতই দুর্গা পুজোর বৃদ্ধির সাথে সাথেই কৃষ্ণনগরের কারিগরদের আস্তানা হল শহরে যার সাবেকি নাম কুমোরটুলি।
কিন্তু ইংরেজ তখন আরেক হিসেব নিকেশে ব্যস্ত। তার লক্ষ এদেশে শাসকের দেবকুল বা ডিভাইন স্টেট গড়ে তোলা। ইংরেজ এদেশে উপনিবেশবাদি দেবকুল প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় নিয়ে একের পর এক ইংরেজ শাসকদের মূর্তি বসাতে থাকে কলকাতায়। নানা প্রতীক চিহ্নের আড়ম্বরে শাসককে সাধারণ মানুষের চোখে দেবতা বানানো হয়। আর সেই দেবতা দাঁড়িয়ে থাকে রাজপথে। গৃহ অন্দরের সিংহাসনে এই শাসক দেবতার আসন নেই। কিন্তু ইংরেজ চিন্তনে ক্যালকাটা সেদিন ডিভাইন স্টেট। সেই থেকেই কলকাতা মূর্তিময়।
একদিকে বৎসরান্তে সন্তান সন্ততি নিয়ে দুর্গা হাজির হন মূর্তি রূপ ধারণ করে আর অন্যদিকে ডিভাইন স্টেটের ইংরেজ মূর্তিরা বছর ভোর রোদে জলে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে যিনি ‘কীর্তিমান তিনিই মূর্তিমান’। এই মূর্তি সমীহ আদায়ের মূর্তি কিম্বা অমরত্বে আকাঙ্খার মূর্তি।
এরই মধ্যে এলো নব জাগরণ। দেশের মানুষের ঘুম ভাঙলো। একে একে নব জাগরণের পথিকেরা নেমে এলেন ভারত ভূমিতে। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ মিলিয়ে এক লম্বা তালিকা। সঙ্গে যুক্ত হল স্বাধীনতা মন্ত্রের মহানায়কদের মুক্তির সংলাপ। সকলেই শ্রদ্ধার আসন পেলেন মানব হৃদয়ে। মানুষ মনে করল শ্রদ্ধাভাজনের মূর্তির পাদদেশে মন আশ্রয় পায়, ভাবনা দিশা পায়। তাই প্রাক স্বাধীনতা পর্বেই অনেক ভারতীয় জনায়কের মূর্তি বসল কলকাতায়। স্বাধীনতার পরেও সেই ধারা প্রবহমান রইল, মানুষের তাতে কোনও অবজ্ঞা রইল না।
তাই কলকাতায় মূর্তিকথা যেন ত্রিবেণী সঙ্গমের মতো। একদল ইতিহাসের অতীত, একদল আজও সজীব তাঁদের আদর্শের বিচারে ও পথ প্রদর্শকের উচ্চতায় আর সবার মাঝে চিরস্থায়ী দুর্গা। তফাৎ একটাই। কেউ চেয়েছে অমরত্ব, কেউবা শ্রদ্ধার আসন আর দুর্গার কাছে গিয়ে মানুষ পায় প্রতিবাদী লড়াই আর আত্ম বলিদানের প্রেরণা সঙ্গে অনুভব করে ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’। আর সাথে জারি থাকে দুর্গা মূর্তি নির্মাণের চলমান শিল্প বিপ্লব।